শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন

কোরোনা ভাইরাস : অর্থনৈতিক মহামন্দা ও আমাদের সিদ্ধান্তহীনতা! ? Matrijagat TV

মুফিজুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি কুয়েত :
  • আপডেট টাইম শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০

কোরোনা ভাইরাস প্রথম সনাক্ত হয় চীনের উহান শহরে ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৯ ইং তারিখে। সনাক্ত হওয়ার পর আস্তে আস্তে তা মহামারির আকার ধারন করে। বন্ধ হতে থাকে চীনের আন্তঃ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরবর্তীতে বন্ধ করে দেয়া হয় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও।চীন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সারা বিশ্ব হতে। তখনও আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এর ভয়াবহতা।

আর আমরা নিজেদের সব দিক থেকে সামর্থ্যবান হিসেবে ভাবতে করতে শুরু করি, আমদের অর্থনীতি, চিকিৎসা সেবা, সিকিউরিটি সিস্টেম,নিয়মানুবর্তীতা, জনসচেতনতা সর্বপরি সার্বিক সামর্থ্যে আমরা অন্যদের থেকেও অনেক অনেক গুন বেশী এগিয়ে। আর তাই নানা জায়গা থেকে অপপ্রচার শোনা যায়” কোরোনা এমন কোন মহা শক্তিধর নয়, যে আমরা পরাজিত করতে পারবো না, আমরা কোররোনা থেকেও শক্তিশালী ” আর তাই এই নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন, মসজিদে নামাজ আদায় করা নিয়েও বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার করতে থাকে কেউ কেউ ।

যখন মানুষকে সচেতন করার দরকার তখন আমরা সচেতন না হয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করতে ফেলেছি, যে কোরোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে এক মহামারি হিসেবে আবির্ভাব হতে যাচ্ছে । ঠিক যেন ইতিহাসের সেই ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়- সর্ব প্রথম ভাইরাস থেকে বাঁচাতে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে যে ডাক্তার বলেছিলেন তাঁকে পরবর্তীতে পাগল স্বাবস্থ্য করে পাগলাগারদে পাঠানো হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাকে সেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।(লুই পাস্তুরের জীবাণু তত্ত্ব আবিষ্কার এর বহু বছর পর সেই ডাক্তার স্বীকৃতি পান, এখন সেই দেশে তাঁর নামে বড় বড় স্টেচু বানিয়ে রাখা হয়েছে,তিনি হলেন হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ) ।

আমরাও তেমনই ভাবতে শুরু করলাম,অন্যেরা যখন প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করছে আমরা তখন নিজেদের বোকামি’র পরিচয় দিচ্ছি এবং বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভাবছি আর অবুঝের মত কথা বলছি। যার এ বিষয়ে জ্ঞান নেই সেও বিরামহীন ভাবে অসচেতন মূলক কথা বলে যাচ্ছে। বিভ্রান্তিকর তথ্য ও গুজব রটিয়ে যাচ্ছে এক এক শ্রেণীর মানুষ ।

এমনি করে ভাবতে ভাবতেই আমাদের সময় পার হয়ে গেল এবং ইতিমধ্যে বিশ্বের ২০০টির ও বশী দেশে কোরোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় এরই মধ্যে বিদেশ থেকে দেশে ফেরত এসেছেন ৯ লাখের ও অধিক নাগরিক এবং ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিদেশ ফেরত সকলকেই এয়ারপোর্ট এ পরীক্ষা করে সেলফ কোয়ারেন্টাইন এ পাঠানো হবে এবং অনেককেই নিয়ে যাওয়া হলো সরকারী ব্যবস্থাপনায় যেখানে কোন প্রকার চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা নেই, দেখা দিতে থাকলো আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা তথা অসক্ষমতা সাথে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি, এবং একই সাথে আমাদের সক্ষমতা, যারা সেবা দিবে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা(PPE) নেই, কোথায় কোথায় সেবা পাওয়া যাবে তার সুনিদিষ্ট কোন হাসপাতালের নাম বা সংখ্যা নেই, বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল রোগী দেখা বন্ধ করে দিল ভয়ে তথা বানিজ্যিক স্বার্থে ।

রাতে যারা না ঘুমিয়ে জ্ঞান বিলাতেন তাদের ভাষার সচেতন করতেন এবং যাদের এগিয়ে আসার কথা তাঁরা যেনো হঠাৎ করে আড়ালে চলে গেলেন। এক অনিশ্চয়তার মধ্যে এ দেশ ও দেশের মানুষ আর এরই মধ্যে কোরোনা’য় আক্রান্ত রোগীর দেখা মেলল। ততক্ষণে প্রায় তিন মাস এর কাছাকাছি সময় পার হয়ে গেল।গত তিন মাসে সারা বিশ্বে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এক লাখের ও বেশী মানুষের আর আক্রান্ত হয়েছে এ মরণ ব্যধিতে ২০ লাখের ও বেশী মানুষ ।আর নিজ দেশে প্রতিদিন ই মৃত্যু আর রোগাক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা কেন দেরিতে সিদ্ধান্ত নেই, কেন আমরা আমাদের গা’য়ে এসে না পড়লে আমাদের বুঝ আসেনা।আমাদের ইতিহাস তাই বলে, মৃত্যু না দেখলে আমাদের হোস হয় না । যখন বুঝলাম তখন দেশ লক ডাউন করে দিলাম এবং সারা বিশ্ব তার আগেই লক ডাউন হয়ে গেছে। কিন্ত এ কাজটি করার আগে আমরা কোন পরিসংখ্যান দাড় করাতে এখন অবধি সক্ষম হতে পারিনি যে, যারা দিন আনে দিন খায় এমন লোকের সংখ্যা কত? তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেই লক ডাউন ঘোষণা করা উচিত। তাদের খাবার না দিলে তো তাঁরা ঘর থেকে বের হয়ে আসবেই, কেননা ঘরে থাকলেও না খেয়ে মরতে হবে, তাই তাদের বের হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এতে কমিউনিটি ঝুঁকি বাড়বে। এই হত দরিদ্র মানুষ গুলো কোরোনা নয়, না খেয়েই মারা যাবে। এ ব্যপারে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা অভাব ছিল দায়িত্বশীল জায়গা থেকে। এ সাধারণ চিন্তা করার মত যেনো কেউ নেই। ত্রান বিতরণে সম্মনয়ের অভাব সর্বত্রই।এবং একই সাথে লুটতরাজের ভয়াভয় চিত্র এ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল।

কোরোনা’র বড় আঘাত আসবে বিশ্ব অর্থনীতে যার প্রভাব পড়বে আমাদের জাতিয় অর্থনীতিতে ও। বিশেষজ্ঞদের মতে এতে বেকার হয়ে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। আমদানী বন্ধ থাকার কারনে নিত্য পণ্যের দাম বাড়বে, এক দিকে চাহিদার আধিক্য আর অন্যদিকে যোগানের স্বল্পতার কারণে চাহিদা-যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিবে ।আর তাতে বৃদ্ধি পাবে ভোগ্য পণ্যের দাম তথা মুদ্রাস্ফীতি। অর্থনীতিতে দেখা দিবে স্টেগফ্লেশন। একদিকে বেকারত্বের চাপ অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করবে।

জাতীয় আয়ের বেশির ভাগ আসে রপ্তানি খাত থেকে আর রপ্তানি খাতের বড় অংশই তৈরী পোশাক শিল্প। পোশাক শিল্পের ৬২ শতাংশ আয় আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ শতাংশ আসে আমেরিকা হতে। আর সেসব দেশে মহামারি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। এতে গার্মেন্টস শিল্পে বড় ধরণের অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিবে। ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করছে প্রতিনিয়ত আর অন্যদিকে সবকিছু প্রস্তুত করেও মাল পাঠাতে পারছে না রপ্তানিকারকরা। অন্যদিকে এর প্রভাব পড়বে ব্যাংকিং খাতে। ঋণ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ এ ব্যর্থ হবে, ফলে এক দিকে যেমন নন পারফরমিং লোন এর সংখ্যা বাড়বে অন্য দিকে নতুন করে ঋণ সুবিধা প্রদানে ব্যাংক গুলোর মধ্যে তারল্য সংকট দেখা দিবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপান বন্ধ থাকায় ব্যাংক ঋণের মধ্যে পড়ে তাদের নাভিশ্বাস দেখা দিবে।

আমাদের আমদানী ব্যয়ের বড় অংশ আসে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স থেকে। এ অবস্থায় যেহেতু অনেকেরই চাকরী হারাতে হবে তাই রেমিটেন্স প্রবাহ ও কমবে ব্যাপক হারে ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট দেখা দিবে। ফলে আমদানী ব্যয় নির্বাহ সমস্যার সম্মুখীন হবে। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতায় পড়বে। আমদানী -রপ্তানি বাণিজ্যের অচল অবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, শেয়ার বাজার ধস, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যকারত্ব, জাতীয় প্রবৃদ্ধি হ্রাস, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অচল অবস্থা ,ফলে কোরোনা’র পাশাপাশি সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মহা মন্দা দেখা দিবে, বিশেষজ্ঞদের মতে এ মহা মন্দা ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়কে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্ব ব্যাংক এর মতে বিশ্ব অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ তথা ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যাবে। ধারণা করা হয়েছিল বিশ্ব প্রবৃদ্ধি ৩.৩ হবে ,কিন্তু কোরোনা’র প্রভাবে তা কমে ৩ এর নীচে চলে আসবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের জাতিয় প্রবৃদ্ধি গত বছরের অর্ধেক এ নেমে আসবে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে ৩ লাখ কোটি ডলার। কাজেই আমাদের এখনই এ ব্যপারে করণীয় নির্ধারণ করা উচিত, আর যদি আমরা সময় নষ্ট করে বসে থাকি আর ভাবি হলে পরে দেখা যাবে, তাহলে এর খেসারত দিতে হবে আজকের ইউরোপ, আমেরিকার চাইতেও বেশী। কেননা আজকের এই অবস্থার জন্য তাঁদের গুরুত্বহীনতাই দায়ী। যা সামাল দেয়া আমাদের দেশের অর্থনীতর পক্ষে সম্ভব নয়। করোনা,য় যত মানুষ না মরবে তার থেকেও শত গুন মানুষ মরবে অনাহারে। মহামারি আর অর্থনৈতিক মহা মন্দার ফলে দুর্ভিক্ষ যেনো এ সময়ে পাশাপাশি অবস্থান করছে এটা বুঝতে হবে। আমাদের মত স্বল্পউন্নত দেশের জন্য যা হবে চরম ভয়াবহ।

কেননা ইতিমধ্যেই বিশ্বের সাথে প্রায় সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ ,কবে স্বাভাবিক হবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।আমদানীকৃত পণ্য কবে বন্দরে আসবে তাও বলা যাচ্ছে না । রপ্তানির চাকা কবে সচল হবে তাও অনিশ্চিত, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসা কবে স্বাভাবিক হবে তাও আগাম ধারণা করা যাচ্ছে না, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে কবে প্রাণ ফিরে আসবে তাও অনিশ্চিত, কি পরিমাণ ব্যাংকিং সুবিধা দিলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে তাও এখন বলা যাচ্ছে না। কাজেই জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল করতে ,সন্মুখ বিপদ মোকাবেলায় এখনই করণীয় ঠিক করতে হবে। নীতি নির্ধারকদের খাত ভিত্তিক দিক নির্দেশনা দিতে হবে খুবই স্বচ্ছ ভাবে।

আর যদি আমরা এবার ও প্রতি বারের মত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করি ,তাহলে পরিনতি হবে চরম ভয়ানক যা কোন ভাবেই সামাল দেয়া সম্ভব পর হবে না। একই সাথে সরকারের উচিত হবে এই মুহূর্তে ন্যাশনাল ক্রাইসিস ঘোষণা করা এবং সকল বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া তারা শুধু সরকারের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নিবে আর রাষ্ট্রের বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়াবে না তা হবে না, যে সকল প্রতিষ্ঠান এ সময় যত বেশী সহায়তা দিবে পরবর্তীতে সরকার তাদের ব্যবসায়ীক সুযোগ সুবিধা ও আনুপাতিক হারে প্রদান করবে।অন্যদিকে আজ দেশের National Crisis এর সময়—-কেনো বড় বড় দেশী ও বিদেশী কোম্পানী এবং ব্যবসায়ী সংগঠন গুলো সরকারকে বলতে পারছেন না এদেশের মানুষের ২ মাসের খাবারের দায়িত্ব আমরা নিলাম আর আপনি আমাদের দায়িত্ব নেন। এ দেশের প্রতি টা মানুষ যেন ঘরে থাকে। কেন বলতে পারছেন না ? এ বিষয়গুলোও সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত । আশাকরি নীতি নির্ধারক গন এ সকল ব্যপারে যথেষ্ট সচেতন ও যত্নবান আছেন এবং এ ধরণের সমস্যা মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন।

লেখক:

মুহাম্মদ আল-মামুন কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
© All rights reserved © Matrijagat TV
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
matv2425802581