চারদিকে সবুজ পাহাড়-টিলাবেষ্টিত সিলেট একসময়ে দীঘি ও জলাধারের শহর হিসেবেও পরিচিত ছিল। নগরীর অনেক এলাকার নামকরণ করা হয় বিশালাকার সেসব দীঘি ও জলাধারের নামে। কালের আবর্তে নগরায়নের প্রতিযোগিতায় সিলেটের সেই পরিচয় এখন হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় নগরীর আরেকটি জলাধার হারিয়ে যেতে বসেছে। নগরীর প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজার সংলগ্ন কাষ্টঘরের ‘জল্লা’ নামে পরিচিত জলাভূমি এবার নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। প্রশাসনের নাকের ডগায় হাবিবুর রহমান মজলাই গং গিলে খাচ্ছে এই জলাভূমি। বিশাল এই জলাভূমির অনেক জায়গায় মাটি ভরাট করে বেশকিছু বহুতল ভবন তৈরি করা হচ্ছে। আবার কোথাও টিনশেডের ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। খালি জায়গায় মাটি ভরাট করে রাখা হয়েছে প্লট হিসেবে বিক্রির জন্য। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রাকৃতিক জলাধারের এভাবে শ্রেণি পরিবর্তন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও সংশ্নিষ্টরা নির্বিকার। সরেজমিনে দেখা গেছে, কিছু কিছু প্লট এরই মধ্যে ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। আবার কিছু প্লট এখনও পানির নিচে কচুরিপানাভর্তি নিচু ভূমিতে রয়েছে। এখানে ৪ শতক,৫ শতক বা আরও বড় প্লট পাওয়া যায়। জল্লার আরেক অংশে গড়ে উঠেছে মাদানী হাউজিং। নগরীর কাষ্টঘর সংলগ্ন এই অংশে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। আরও অনেক খালি প্লটে সাইনবোর্ডে মালিকের নাম-পরিচয় লেখা রয়েছে। তাদের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন রয়েছেন। এই আবাসন প্রকল্পের নেপথ্যে প্রভাবশালী হাবিবুর রহমান মজলাইসহ কয়েকজন জড়িত থাকায় প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকাশ্যে জলাভূমি ভরাট করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রকাশ্যে না এলেও মাদানী সিটির নেপথ্যে হাবিবুর রহমান মজলাই মদদদাতা হিসেবে রয়েছেন বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিগত দিনে বিশ্ব পানি দিবসে সিলেটে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় কাষ্টঘরের জল্লা দখলের বিষয়টি উঠে আসে। এতে সিলেটে বেলার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার সিলেট সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ পুকুর-দীঘি-জলাশয়গুলোর বর্তমান চিত্র তুলে ধরে এগুলো সংরক্ষণে করণীয় নির্ধারণে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর জলাধার রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্নিষ্ট সবার যৌথ উদ্যোগের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন,পুকুর,দীঘি, জলাশয় উদ্ধার ও সংরক্ষণে করপোরেশন অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক জলাশয়ের মালিকানা জেলা প্রশাসনের আওতায় থাকায় করপোরেশনের পক্ষে এগুলো উদ্ধার বা সংরক্ষণে আইনি জটিলতা রয়েছে। এ অবস্থায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নগরীর জলাধারগুলো সংরক্ষণ সম্ভব বলে মন্তব্য করেন মেয়র। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি প্রয়োজনে বেলার পক্ষে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান বেলার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার। ভূমি অফিস সূত্র জানায়, কাষ্টঘরের জল্লায় ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু জায়গার পাশাপাশি পতিত ও ওয়াকফ সম্পত্তিও রয়েছে। এই জল্লার কিছু জায়গা সরকারি খাস জমি হিসেবে রেকর্ড আছে। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন,সিংহভাগ প্রাকৃতিক জলাধারই সাধারণত সরকারি খাস জমি। এই হিসেবে জলাধার দেখাশোনার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। কাষ্টঘরের জল্লা রক্ষায় প্রশাসন ব্যর্থ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে জলাধারটি রক্ষা করতে হবে। নগরীর ভেতরে জলাধারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন। প্রশাসন ও করপোরেশনকে তাই সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এই জলাধার রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় নগরীর আরও অনেক পুকুর-জলাধারের মতো অচিরেই কাষ্টঘরের এই জল্লার অস্তিত্ব আর থাকবে না, মারা যাবে। সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেকর্ডে জলাধার উল্লেখ রয়েছে এমন কোনো জায়গা ভরাট আইনগত নিষিদ্ধ। একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গাও ভরাটের অনুমতি দেয় না। তিনি বলেন, নগরীর কোথাও জলাধার ভরাট করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কেউ তা করে থাকলে, সেটা আইনত অপরাধ।চলমান খবর !!,
Leave a Reply