ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে শত-নারীকে পথ দেখাচ্ছেন রিনা-আক্তার। দরিদ্র-অসহায় গৃহবধূ ও দরিদ্র পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের চোখে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরি করে দারিদ্রতাকে জয় করে স্বাবলম্বী হওয়ার এই স্বপ্ন রচনা করেছেন সংগ্রামী জয়িতা রিনা আক্তার। উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের পাঁচুয়া জব্বার নগর গ্রামের ঘরে ঘরে চলে এই স্বপ্নের নিখুঁত বুনন। জানা যায়, উপজেলার পাঁচুয়া জব্বার নগর গ্রামের বেকার যুবক কামাল খানের সাথে ১৯৯৭ সালে রিনা আক্তারের বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামীর ঘরে অভাব-অনটন ও আর্থিক দৈন্যতা দেখে রিনা আক্তার হতাশ হয়ে পড়েন। ভেতরে ভেতরে উত্তরণের পথ খোঁজেন। স্বপ্ন দেখেন সুখের। এভাবে কেটে যায় ৬ বছর। ২০০৩ সালে রিনার কোলে তখন ৩ মাস বয়সী কন্যা সন্তান। এ অবস্থায় তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকায় বসবাসরত খালাত বোন শিল্পী আক্তারের সাথে। তিনি হাতের কাজ (চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরি) শেখার পরামর্শ দেন, তবে ঢাকায় গিয়ে শিখতে হবে। এর পর থেকে রিনা তিন মাস বয়সী কন্যাকে বাড়িতে রেখে প্রতিদিন ঢাকায় কাজ শিখতে যান। এতে স্বজন ও প্রতিবেশীদের সমালোচনার তীর রিনাকে আহত করলেও মুখ বুঝে সহ্য করেন। স্বামীসহ পরিবারের লোকজন ঢাকায় গিয়ে কাজ শিখতে নিষেধ করেন। কিন্তু জেধী রিনা সমালোচনা ও নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে অল্পদিনেই কাজ শিখে ফেলেন। এর পর থেকেই শুরু হয় তার নিখুঁত স্বপ্ন বুনন। মাসে একবার ঢাকায় গিয়ে অর্ডার (চাহিদা), ক্যাপ তৈরির উপকরণ ও সামগ্রী নিয়ে আসেন এবং তৈরি শেষে ঢাকায় দিয়ে আসেন। পরে এই ক্যাপগুলো বিভিন্ন মডেলের কাটিং করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শপিংমলে উচ্চমূল্যে সরবরাহ রপ্তানি করেন ব্যবসায়ীরা। রিনা আক্তার দুই ধরনের ক্যাপ তৈরি করেন। একটি ক্যাপ তৈরি করে তিনি পারিশ্রমিক পান ১২শ’টাকা, আরেকটির পারিশ্রমিক ৫শ’ টাকা। স্বামী-সংসার সামলে একটি ক্যাপ তৈরি করতে সর্বোচ্চ দুইদিন সময় লাগে। এ ভাবে ঘরে বসেই রিনা আক্তার মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করে অল্পদিনেই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। সংসারের অভাব-অনটনকে পেছনে ফেলে তিনি ১০/১২ কাঠা জমি কিনেছেন। ৫ কক্ষের একটি বিশাল হাফ বিল্ডিং বাড়ি তৈরি করেছেন। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে ‘অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ হিসাবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর রিনা আক্তারকে জয়িতা নির্বাচিত করেন। তবে শুধু নিজে স্বাবলম্বী হওয়া বা জয়িতা নির্বাচিত হওয়া নয় রিনা আক্তার নিজ উদ্যোগে গফরগাঁওয়ের পাঁচুয়া-জব্বার নগরসহ বিভিন্ন স্থানে হতদরিদ্র দুই শতাধিক গৃহবধূ ও দরিদ্র পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীকে বিনামূল্যে ক্যাপ তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এতে এক পাঁচুয়া-জব্বার নগর গ্রামেই সহস্রাধিক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পাঁচুয়া-জব্বার নগর বিভিন্ন বাড়িতে গৃহবধূরা সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরি করছেন। হতদরিদ্র পরিবারের স্কুল কলেজ পড়ূয়া ছাত্রীরাও পড়ালেখার ফাঁকে ক্যাপ তৈরি করছেন। প্রত্যেকে সপ্তাহে অন্তত ৩টি ক্যাপ তৈরি করতে পারেন। এতে ১২শ’ টাকা হারে সপ্তাহে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন ৩৬শ’ টাকা। পরে রিনা আক্তার তৈরি করা ক্যাপগুলো সংগ্রহ করে ঢাকায় দিয়ে আসেন। এতে রিনা আক্তারের অতিরিক্ত আয় হচ্ছে। তবে ইদানিং ঢাকার অন্য ব্যবসায়ীরা জব্বার নগরে বাসা ভাড়া নিয়ে ক্যাপ তৈরির ছোটখাট কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। ঢাকার আব্দুল মানুন তুকার নামে এক ব্যবসায়ী এই গ্রামের মুর্শিদ আলী খাঁর হাফ বিল্ডিং বাসা ভাড়া নিয়ে চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরির একটি কম্পানি করেছেন। এখানে প্রায় ৫০ জন নারী সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি মাসে একবার এসে ক্যাপ তৈরির সরঞ্জাম ও পারিশ্রমিক দিয়ে তৈরি করা ক্যাপগুলো নিয়ে যান। আবার একই গ্রামের জনৈক ছাবে খাঁর বাড়িতে প্রায় ৩০-৩৫ জন নারী কাজ করেন। জয়িতা রিনা আক্তার বলেন, আমি বিনামূল্যে বহু নারীকে চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরি শিখিয়েছি। সরকারিভাবে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে এখান থেকেই অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হতো। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, আমার এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলোতে বহু নারী চুল দিয়ে ক্যাপ তৈরির কাজ করে আয় করছেন। এতে পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে। নারীরাও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। এক সময় যেসব বাড়িতে মাটির ঘর ছিল এখন সেখানে পাকা ঘর তৈরি হচ্ছে।তিনি জানান, সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে নারীদেরকে আরো প্রশিক্ষণ দিয়ে, ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে এটিকে শিল্প হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এলাকাটি পরিদর্শন নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। যাতে সহজেই এই-সকল-নারীরা সহজেই ক্ষুদ্র ঋন-পায়। এব্যপারে সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা-হবে।।।
Leave a Reply